Column 2

নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় বুদ্ধ বিহার ও ড. শাসনরক্ষিত ধ্যান কেন্দ্রের পুন:প্রতিষ্ঠায় শ্রদ্ধাবান উপাসক প্রয়াত বাবু বেনুতোষ তালুকদারের অবদান ও কিছু স্মৃতিকথা ~প্রলয় বড়ুয়া

সারাংশ:

\(\qquad\) আমরা বৌদ্ধরা কর্মে বিশ্বাসী, সকলেই নিজ নিজ কর্মের উত্তরাধীকারী হই – অর্থাৎ যাঁরা বুদ্ধ শাসনের প্রচার, প্রসার, রক্ষা ও স্থিতি কল্পে সক্রিয় অবদান রাখেন তাঁদেরকেই আমরা আজীবন স্মরণ করি। তেমনি শ্রদ্ধাবান উপাসক প্রয়াত বাবু বেনুতোষ তালুকদার আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন এবং থাকবেন তাঁর বুদ্ধ শাসনের শ্রীবৃদ্ধিতে সাংঘঠনিক ও দানকর্মের মাধ্যমে। ২০১২ইং সালে ভদন্ত ড. শাসনরক্ষিত মহাথের মহোদয় পরলোকগত হবার পর তাঁর বুদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠাকল্পে ক্রয়ক্রিত জমিটি যখন আইনি জটিলতার জন্য প্রায় হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল তখন বাবু বেনুতোষ তালুকদার জমিটি পুনরুদ্ধারের জন্য এক অগ্রনী ভূমিকা রেখেছিলেন। সেই ক্রান্তিকালীন সময়ে তিনি সক্রিয় হয়ে নিজ অর্থায়নে জমিটি উদ্ধার করেছিলেন এবং সরকারী খাতায় নথিভূক্ত করিয়েছিলেন। তাই আজকে আমরা যে নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় বুদ্ধ বিহার ও ড. শাসনরক্ষিত ধ্যান কেন্দ্র দেখছি এবং পূন্যানুষ্ঠান করার সুযোগ পাচ্ছি তা মূলতঃ বাবু বেনুতোষ তালুকদারের সময়োপযোগী পদক্ষেপ, অক্লান্ত পরিশ্রম, ও ঔদার্যতার ফসল যা নারায়ণগঞ্জের বৌদ্ধ সমাজে চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

সূচনা:

\(\qquad\) নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় বুদ্ধ বিহার ও ড. শাসনরক্ষিত ধ্যান কেন্দ্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় শ্রদ্ধাবান উপাসক প্রয়াত বাবু বেনুতোষ তালুকদারের অবদান ও স্মৃতিচারণের পূর্বে এদেশের বরেন্য বৌদ্ধ ভিক্ষু ড. শাসনরক্ষিত মহাথের মহোদয় সম্পর্কে একট্ আলোকপাত করতে হয়। ড. শাসনরক্ষিত মহাথের মহোদয় রাউজান উপজেলার অন্তর্গত আবুলখীল গ্রামে ১৯২৯ইং সালে জন্মগ্রহন করেন। তিনি ভারতের পুনে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অভিধর্মের উপর ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার দায়িত্বভার গ্রহন করেন। ড. শাসনরক্ষিত মহাথের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা শেষ করে অবসর গ্রহনের কয়েক বছর পূর্বে ১৯৮৮ইং সালে বৌদ্ধ ধর্মীয় সাহিত্যকর্ম ও ধ্যান-সমাধী অনুশীলনের মানশে ফতুল্লায় দাপা ইদ্রাকপুরে নিজ অর্থায়নে পাঁচ শতাংশ জমি ক্রয় করেছিলেন।

\(\qquad\) ১৯৯৫ইং সালে ড. শাসনরক্ষিত মহাথের মহোদয় ফতুল্লায় ছোট্ট পরিসরে একটি বিহার নির্মান করেন এবং তথায় নিয়মিত বসবাস করছিলেন। ধ্যান-সমাধী অনুশীলন ছাড়াও এখানে বিহার প্রতিষ্ঠার আরেকটি অন্যতম কারন হল – নারায়ণগঞ্জ বাংলাদেশের একটি শিল্পনগরী হওয়াতে (প্রাচ্যের ডান্ডি নামে খ্যাত) এখানে চাকরি ও ব্যবসা-বানিজ্যের সুবাদে অন্য জেলা হতে বহু বড়ুয়া, চাকমা, মারমাসহ বৌদ্ধ ধর্মাবল্বীরা আগমন করেন এবং তাদের ধর্মানুশীলনের সুযোগ করে দেয়া। যেহেতু ড. শাসনরক্ষিত মহাথের মহোদয় এখানে বর্ষাবাস যাপন করেছিলেন, ১৯৯৫ ও ১৯৯৬ইং সালে ফতুল্লায় পর পর দুইবার কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তখন থেকে আসলে ফতুল্লায় একটি বৌদ্ধ বিহারের অস্থিত্ব পরিলক্ষিত হয়। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ১৯৯৬ইং সালে ফতুল্লায় কঠিন চীবর দানে উপস্থিত থাকার। এরপর ১৯৯৭ থেকে ২০১১ইং সাল পর্যন্ত এই ১৫ বছরের মধ্যে একবারও আনুষ্ঠানিকভা কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠিত হয়নি যদিও ২০০৩ ও ২০০৪ইং সুমেধ বড়ুয়ার (বর্তমানে অত্র বিহারের অর্থ সম্পাদক) বাসায় অনারম্বর কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ২০১২ইং সাল থেকে নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় বুদ্ধ বিহার ও ড. শাসনরক্ষিত ধ্যান কেন্দ্র পূনঃপ্রতিষ্ঠার পর এখানে নিয়মিত কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কিন্তু কিভাবে এই বিহার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলো, কে এই বিহার পূনঃপ্রতিষ্ঠায় অগ্রনী ভূমিকা রেখেছিলেন সে বিষয়ে একটু আলোকপাত করা যাক।

নারায়ণগঞ্জে বুদ্ধ বিহার পুন:প্রতিষ্ঠায় বাবু বেনুতোষ তালুকদারের অবদান:

\(\qquad\) আপনারা হয়তো অনেকেই অবগত আছেন ভদন্ত ড. শাসনরক্ষিত মহাথের মহোদয় ২০১২ইং সালে পরলোকগত হয়েছিলেন। ড. শাসনরক্ষিত ভান্তে মৃত্যুর পূর্বে কয়েকটি বছর (আনুমানিক ২০১০-২০১২ইং) কাটিয়েছিলেন চট্টগ্রাম শহরের অর্ন্তগত মোগলটুলী শ্মশানভূমি শাক্যমুণি বুদ্ধ বিহারে। তথায় পন্ডিত প্রবর ভদন্ত প্রজ্ঞাবংশ মহাথের মহোদয় এবং তাঁর শিষ্যরা অসুস্থ ড. ভান্তের পরম সেবা-শুশ্রূষা করেছিলেন। উল্লেখ্য অন্তিম যাত্রার পূর্বে ড. শাসনরক্ষিত ভান্তে তাঁর ফতুল্লার পাঁচ শতাংশ জমিটি ভবিষ্যতে তাঁর নামে একটি ভাবনা কেন্দ্র স্থাপন কল্পে ভদন্ত প্রজ্ঞাবংশ মহাথের মহোদয়কে (মৌখিকভাবে) দান করে গিয়েছিলেন। তখন ড. শাসনরক্ষিত ভান্তে এই বিহারের নামকরন করেছিলেল “নারায়ণগঞ্জ বুদ্ধ বিহার ও ড. শাসনরক্ষিত ধ্যান কেন্দ্র” কিন্তু ভদন্ত প্রজ্ঞাবংশ মহাথের “কেন্দ্রীয়” শব্দটি সংযোজন করে এই বিহারের নামকরন করেন “নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় বুদ্ধ বিহার ও ড. শাসনরক্ষিত ধ্যান কেন্দ্র”। ২০১২ইং সালে এই বিহার পূনঃপ্রতিষ্ঠার সূচনালগ্ন থেকে পন্ডিত প্রবর বহু গ্রন্থ প্রনেতা ভদন্ত প্রজ্ঞাবংশ মহাথের মহোদয়র অন্যতম প্রিয় শিষ্য ভদন্ত চন্দ্রবংশ থের এই বিহার পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন।

\(\qquad\) ২০১২ইং সালে ভদন্ত ড. শাসনরক্ষিত মহাস্থবির মহোদয়ের মৃত্যুর পর তাঁর বুদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠাকল্পে ক্রয়ক্রিত জমিটি যখন আইনি জটিলতার জন্য প্রায় হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল তখন বাবু বেনুতোষ তালুকদার জমিটি পূনরুদ্ধারের জন্য তথা বুদ্ধ শাসনের স্থিতি কল্পে এক অগ্রনী ভূমিকা রেখেছিলেন। সেই ক্রান্তিকালীন সময়ে তিনি সক্রিয় হয়ে নিজ অর্থায়নে জমিটি উদ্ধার করেছিলেন এবং সরকারী খাতায় নথিভূক্ত করিয়েছিলেন। আপনারা অনেকেই জানেন ড. শাসনরক্ষিত ভান্তে দীর্ঘদিন (১৪-১৫ বছর) ফতুল্লায় কাটিয়েছিলেন এবং তথায় ড. ভান্তের পরিচিত এক অ-বৌদ্ধ পরিবার ভান্তের দেখভাল করতেন। এই দীর্ঘদিনের সেবা-শ্রূষার সুযোগ নিয়ে ঐ পরিবারটি ড. ভান্তের কাছ থেকে তাঁর জমিটার অর্ধেকটা দান হিসেবে লিখিয়ে নেন এবং কৌশলে ঐ জমির দলিলে ড. ভান্তের স্বাক্ষর করিয়ে নেন। এর অর্থ দাড়াঁয় সেই প্রতারক পরিবারটি তখন ড. ভান্তের অর্ধেক জমির আইনগত মালিক। কথিত আছে, এক পর্যাযে সেই অসৎ পরিবারটি ভান্তেকে তাঁর নিজের জমি থেকে পর্যন্ত বিতারিত করেছিলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে ড. ভান্তে তখন আনুমানিক ২০০৮ইং সালে তিনি কক্সবাজার চলে যান এবং তথায় কছুকাল অতিবাহিত করার পর ২০১০ইং সালে চট্টগ্রামের মোগলটুলী শ্মশানভূমি শাক্যমুণি বুদ্ধ বিহারে আমৃত্যু অবস্থান করেন।

\(\qquad\) উল্লেখ্য ড. শাসনরক্ষিত মহাথের মহোদয় জীবিত থাকা অবস্থায় ভদন্ত প্রজ্ঞাবংশ মহাথের মহোদয় একবার নারায়ণগঞ্জে এসেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল ফতুল্লা ও নারায়ণগঞ্জের সকল দায়ক-দায়িকাবৃন্দকে একএিত করে ড. ভান্তের জমিটি পূনরুদ্ধারের পরিকল্পনা করা। কিন্তু সেইবার ভদন্ত প্রজ্ঞাবংশ মহাথের ব্যর্থ হয়ে চট্টগ্রামে ফেরত চলে যান। কথিত আছে এক সময় ড. ভান্তেকে কেন্দ্র করে ফতুল্লায় ৫০টি বৌদ্ধ পরিবার ছিল যা ড. শাসনরক্ষিত মহাথের মহোদয় চট্টগ্রাম চলে যাবার পর আস্তে আস্তে হ্রাস পেতে থাকে। যাইহোক, পরবর্তীতে ড. শাসনরক্ষিত মহাথের মহোদয় পরলোকগত হবার পর ভদন্ত প্রজ্ঞাবংশ মহাথের মহোদয় পূনরায় নারায়ণগঞ্জে আসেন। উদ্দেশ্য একই – ফতুল্লা ও নারায়ণগঞ্জের সকল উপাসক-উপাসিকাদের সহায়তায় ড. ভান্তের জমিটি পূনরুদ্ধার করা এবং তথায় একটি বিহার নির্মানের পরিকল্পনা করা। কিন্তু সেইবারও কেউ একক বা যৌথভাবে বিহারের জমি রক্ষায় এগিয়ে আসেননি। তখন সেই সংকটাপন্ন সময়ে বাবু বেনুতোষ তালুকদার জমিটি পূনরুদ্ধারের জন্য এগিয়ে আসেন। তিনি সেই মুসলিম পরিবারকে নগদ চার লক্ষ টাকা দিয়ে আইগতভাবে জমিটি দখলমুক্ত করেন ২০১২ইং সালে। বর্তমান সময় (২০২২ইং)-এর প্রেক্ষাপটে ১০বৎসর পূর্বের সেই আর্থিক সহায়তাকে খুবই সামান্য মনে হতে পারে, কিন্তু একজন অবসর প্রাপ্ত মানুষ যদি সেদিন সঠিক সময়ে এগিয়ে না আসতেন তাহলে এরকম একটি বিহার প্রতিষ্ঠা করতে পারতাম না এবং আমরা দানকার্য সম্পাদন থেকে বঞ্চিত হতাম। তাই আমি আজ এই মহতি পূণ্যানুষ্ঠানে তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।

\(\qquad\) বিহারের জমিটি পূনরুদ্ধারের পর এখন বিহার উন্নয়নের পালা – এখানেও বাবু বেনুতোষ তালুকদার এবং তাঁর স্ত্রী জয়া রানী তালুকদার বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁরা নারায়ণগঞ্জ বুদ্ধ বিহারের উন্নয়ন ও বুদ্ধের বেদী প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন সময়ে আরও সর্বমোট ১৩লক্ষ টাকা শ্রদ্ধাদান দিয়েছিলেন।

বাবু বেনুতোষ তালুকদারের রোগমুক্ত ও সুস্থ জীবনের কিছু স্মৃতিকথা:

\(\qquad\) শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব: বাবু বেনুতোষ তালুকদার ছিলেন একজন শিক্ষানুরাগী ব্যাক্তি। জীবনে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে তিনি বিশেষভাবে উপলব্ধি করতেন নিজেকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছিলেন। তিনি ১৯৬৭ইং সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্যার আশুতোষ সরকারী কলেজ (চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে অবস্থিত) থেকে বি.এস.সি. পাশ করেন। এবং ১৯৮৮ইং সালে ব্যাংকে কর্মরত থাকাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পালি বিষয়ে এম. এ. ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি তাঁর প্রজন্মকেও অনুপ্রানীত করেছিলেন - বিদ্যাশিক্ষার মাধ্যমে জ্ঞানার্জন করে নিজেদের আলোকিত করতে। কারন তিনি বিশ্বাস করতেন শিক্ষা হচ্ছে শিখরে উঠবার সিঁড়ি এবং শিক্ষা ছাড়া জীবন অর্থহীন। তিনি তাঁর তিন মেয়েকে এম. এ. পাশ করিয়ে বিয়ে দিয়েছিলেন যাঁরা বর্তমানে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। তাঁর বড় মেয়ে (মৈত্রী তালুকদার) ইতিমধ্যে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত আছেন। তাঁর মেজ মেয়ে (সাবিত্রী তালুকদার) সেন্ট স্কলাস্টিকা স্কুল এন্ড কলেজ চট্টগ্রামে প্রভাষক হিসেবে এবং ছোট মেয়ে (গায়ত্রী তালুকদার) মাউন্ট রয়েল একাডেমী নারায়ণগঞ্জে সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। দুজনেই শিক্ষকতার পাশাপাশি এম.এড. ডিগ্রী অর্জনের জন্য অধ্যয়নরত আছেন।

\(\qquad\) কঠোর পরিশ্রমী, প্রগতিশীল ও সাংঘঠনিক ব্যক্তিত্ব: বাবু বেনুতোষ তালুকদার ৫-৬ বছর শিক্ষকতা পেশায় জড়িত থাকার পর ১৯৭৩ সালে সম্পূর্ন ভিন্ন একটি পেশায় (ব্যাংকিং সেক্টর) যোগ দেন। পারিবারিক সূত্রে জানা যায় তিনি শিক্ষকতা খুব পছন্দ করতেন এবং অল্প দিনের মধ্যে শিক্ষকতা পেশায় খুব সুনামও অর্জন করেন। কিন্তু তখনকার দিনে শিক্ষকতা পেশায় আর্থিক সুযোগ-সুবিধা খুব কম থাকায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করে তিনি পেশা পরিবর্তন করেছিলেন। আমরা সাধারনত একটি পেশায় ৫-৬ বছর অভিজ্ঞতা অর্জনের পর আর পেশা পরিবর্তন করিনা কিন্তু তিনি প্রগতিশীল ছিলেন বিধায় তা করতে পেরেছিলেন। কঠোর পরিশ্রম, ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের ফলে সোনালী ব্যাংকের কেরানী পদবীতে যোগদান করেও নিজের যোগ্যতা প্রমান করে সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার হয়ে অবসর নিয়েছিলেন। পারিবারিক সূত্রে জানা যায় তিনি নারায়ণগঞ্জের কালিবাজারে ঔষধের ব্যবসাও করেছিলেন ৬-৭বৎসর। দিনেরবেলা ব্যাংকের চাকুরী শেষ করে রাতে ঔষধের দোকানে বসতেন। পারিবারিক সূত্রে আরো জানা যায় তিনি সোনালী ব্যাংকের চাকুরীর প্রথমদিকে ব্যাংকের উদ্বর্তন কর্মকর্তাদের সন্তানদের প্রাইভেট টিউটর হিসাবেও পড়াতেন। কারন অনেক অফিসারই জানতেন তিনি পূর্বে শিক্ষকতা করেছেন। তাছাড়া, আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে তিনি আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহার (মেরুল বাড্ড)-এর কমিটির সদস্য হওয়ায় সাংঘঠনিক কাজেও যুক্ত ছিলেন। অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রমী ও প্রগতিশীল না হলে এতগুলো উৎপাদনশীল কাজ সমান্তরালভাবে করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়।

\(\qquad\) নির্ভীক, দায়িত্বশীল ও হিতৈষী ব্যক্তিত্ব: বাবু বেনুতোষ তালুকদার ছিলেন একজন অত্যন্ত সাহসী ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্বের অধীকারী। তিনি ছিলেন হিতৈষী ও দুরদর্শী একজন মানুষ। তিনি সবসময তাঁর অবর্তমানে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের আর্থসামাজিক নিরাপত্তার কথা ভাবতেন। সেজন্যইতো তাঁর জীবনের সবটুকু সঞ্চয় দিয়ে নারায়ণগঞ্জের গাবতলীতে চার শতাংশ জমি কিনে তিল তিল করে ছয়তলা একটি বাড়ি নির্মান করেছিলেন যাতে তাঁর অবর্তমানে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের তেমন কষ্ট পোহাতে না হয়। শুধু তাই নয় তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকতেই তাঁর বাড়িটি তিন মেয়ে ও স্ত্রীকে দান করেছিলেন যাতে পরবর্তীতে তাদের কোন আইনি জটিলতায় পড়তে না হয়। তিনি পাড়া-প্রতিবেশী এবং স্থানীয় লোকজনদের সাথে খুব সুস্পর্ক বজায় রাখতেন। তাই অত্র এলাকার গন্য-মান্য ব্যাক্তিবর্গদের নিকট তিনি ছিলেন খুবই সুপরিচিত।

\(\qquad\) দানোৎসাহী ব্যক্তিত্ব: বাবু বেনুতোষ তালুকদার নিজে বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহারে শ্রদ্ধাদান দিতেন এবং তাঁর সন্তান ও নিকট আত্মীয়-স্বজনদেরও দান দিতে উৎসাহিত করতেন। তিনি নারায়ণগঞ্জ বুদ্ধ বিহার ছাড়াও নিজ গ্রাম ঘাটচেক ধম্মামৃত বিহারে (রাঙ্গুনীয়া), ধর্মরাজিকা অনাথালয় (কমলাপুর), বোধীজ্ঞান ভাবনা কেন্দ্র (বৌদ্ধ বিহার) (আশুলিয়া), আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহার (মেরুল বাড্ডা), ও প্রয়াত ভদন্ত রাষ্ট্রপাল মহাথের মহোদয়ের মন্দির (বুদ্ধগয়া)-এ শ্রদ্ধাদান দিয়ে বুদ্ধ শাসনের কিছুটা হলেও প্রচার, প্রসার ও স্তিতি কল্পে অংশগ্রহন করেছিলেন। বাবু বেনুতোষ তালুকদারের মৃত্যুর পর সেই শ্রদ্ধাদানের ধারাবাহিকতা এখন তাঁর স্ত্রী ও সন্তানেরা অব্যাহত রেখেছেন।

\(\qquad\) অবসর জীবনের দিনগুলো: আগেই উল্লেখ করেছি বাবু বেনুতোষ তালুকদার প্রায় ৩০বছর সোনালী ব্যাংকে চাকুরী করে ২০০২ইং সালে অবসর নেন। পরবর্তী ৮-৯টি বছর তিনি মানসিকভাবে সুস্থ থেকে সুন্দর ও ব্যস্ত সময় কাটিয়েছিলেন। ২০০৬ইং সালে তাঁর তৃতীয় মেয়েকে বিয়ে দিয়ে তিন মেয়েরই বিবাহ কার্য সম্পন্ন করেন। অবসরে তিনি দুইবার (২০০৪ ও ২০০৭ইং) সস্ত্রীক বুদ্ধগয়া তীর্থ ভ্রমনে যান।

\(\qquad\) অবসরে ওনার একটা শখের খেলাছিল – দাবা খেলা। ওনার প্রতিবেশী ও সহকর্মী বন্ধুদের সাথে (মোশারফ সাহেব, তৈয়ব আলী সাহেব) প্রায় প্রতিদিনই দাবা খেলতেন। মাঝে মাঝে ওনার ছোট মেয়ের (গায়ত্রী) সাথেও দাবা খেলতেন। এমনকি দাবা খেলতে পারেন এমন যেকারো সাথেই দাবা খেলতে চাইতেন। অবসরে ওনার আরেকটা শখ ছিল – বই পড়া। তিনি নিজে বিভিন্ন ধরনের বই পড়তেন এবং তাঁর সন্তানদেরও বই পড়ে জ্ঞানাহরনে উৎসাহিত করতেন।

\(\qquad\) এছাড়া অবসরে তিনি নাতি-নাতনীদের সাথে কোয়ালিটি সময় কাটাতেন। উল্লেখ্য তাঁর ছোট নাতি – প্রতুল ছিল তাঁর অবসরের ভাল বন্ধু যে তার দাদুর অনেক আদর-যত্ন ও ভালবাসা পেয়েছিল। কারন জন্ম (২০০৮ইং) থেকেই সে দাদুর সঙ্গেই ছিল। প্রতুলের সঙ্গে (২-৩বছর বয়সে) তার দাদু অনেক আনন্দের সময় কাটিয়েছিলেন – খেলতেন, খাওয়াতেন, বাহিরে গুড়াতে নিয়ে যেতেন। তাঁর ছয় নাতি-নাতনীদের মধ্যে সবার ছোট নাতনী (প্রজ্ঞা)-কে তিনি দেখে যেতে পারেনি।

\(\qquad\) অবসরে তিনি সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন ছাড়াও নিয়মিত বিহারে যেতেন। উল্লেখ্য তিনি নারায়ণগঞ্জে বুদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠার পর থেকে যতদিন সুস্থ ছিলেন প্রায় প্রতিদিনই দুইবেলা পায়ে হেঁটে বিহারে গিয়ে প্রার্থনা করতেন। ঝড়-বৃষ্টিতেও তাঁর এই নিয়মের কোন ব্যতিক্রম হতনা।

বাবু বেনুতোষ তালুকদারের (জরা-ব্যাধীগ্রস্থ) জীবনের কিছু স্মৃতিকথা:

\(\qquad\) বাবু বেনুতোষ তালুকদার খুব অনাড়ম্বর ও সহজ-সরল জীবন যাপন করতেন। পারিবারিক সূত্রে আরো জানা যায় তিনি ১৯৯০ইং সাল থেকে ডায়াবেটিস রোগে ভূগছিলেন, তখন ওনার বয়স ছিল ৪৬বৎসর। কিন্তু ডায়াবেটিস তাঁকে কখনো কাবু করতে পারেনি। কারন তিনি কঠোর নিয়ম-কানুন মেনে চলতেন (যেমন- নিয়মিত হাঁটা, নিয়ন্তিত আহার, সময়মত ঔষধ সেবন) যা তাঁকে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে রাখতে সহায়তা করেছিল। এমনকি জীবদ্ধশায় ওনাকে কখনও ইনসুলিন ইনজেকশন পর্যন্ত নিতে হয়নি। কিন্তু অনিত্য এই সংসারে মানুষকে এক সময় জরা-ব্যাধীর কাছে হার মানতে হয়, বাবু বেনুতোষ তালুকদারও তার ব্যাতিক্রম নয়। বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে বিশেষ করে ৬৮বৎসর থেকে ডায়াবেটিসের পাশাপাশি তাঁর অন্যান্য জটিলতাও দেখা ধরা পড়ে। যেমন- ডায়াবেটিস রোগ থাকাতে তিনি হঠাৎ দুইবার অসুস্থ হয়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে গিয়েছিলেন। প্রথমবার (২০১১ইং) ওনাকে বারডেম জেনারেল হাসপাতালে (ঢাকা) থাকতে হয়েছিল পাঁচদিন। কারন তাঁর ইলেক্ট্রোলাইট ইমব্যালেন্স (শরীরে খনিজ পদার্থের অসমতা) হয়েগিয়েছিল। দ্বিতীয়বার (২০১৫ইং) ওনাকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল একরাতের জন্য। সেবার ওনার হাইপোগ্লাইসেমিয়া (রক্তের সিরাম গ্লোকোজের মাত্রা বেশী পরিমানে কমে যাওয়া) হয়েগিয়েছিলো।

\(\qquad\) ২০১৩ইং সাল থেকে ধীরে ধীরে তাঁর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থের অবনিত ঘটতে থাকে। হাসিখুশি, উচ্ছ্বল মানুষটা কেমনজানি আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছিল, শখের দাবা খেলাতেও ধীরে ধীরে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। যে মানুষটা তাঁর পরিচিত-অপরিচিত সবার সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা বলতেন ও গল্প করতেন সেই মানুষটা এখন মানুষজন দেখলে বিরক্তবোধ করতেন। অসুস্থতার প্রথমদিকে তাঁকে কোন ডাক্তার দেখানো যায়নি কারন ডাক্তার দেখাতে তাঁর ছিল খুব অনিহা। যাইহোক, ছোট মেয়ের সহায়তায় দেরীতে হলেও তাকে নারায়ণগঞ্জে নিউরোলজিস্ট ডাঃ জাহেদ আলীকে (২০১৫ইং সালে) দেখানো হয়েছিল এবং পরবর্তীতে ঢাকায় অধ্যাপক ডাঃ কনক কান্তি বড়ুয়াকে দুইবার (২০১৫ ও ২০১৬ইং সালে) দেখানো হয়েছিল। উভয় ডাক্তারই বলেছিলেন তাঁর ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে, ঔষধের পাশাপাশি বাড়িতে তাঁর সেবা-শুশ্রূষা করতে। চিকিৎসা বিজ্ঞান মতে মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষগুলির ব্যাপক ক্ষতি হলে ডিমেনশিয়ার উপসর্গগুলি দেখা যায়। যেমনঃ- স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাওয়া, বিষন্নতা এবং উদাসীনতা, বিভ্রম এবং ভুল বকা, চলাফেরায় অসুবিধা, ও ভাষা হারিয়ে যাওয়া বা নির্বাক হয়ে যাওয়া।

\(\qquad\) মৃত্যুর পূর্বের শেষ দুইটি বছর তিনি স্মৃতিশক্তি সম্পূর্ন হারিয়ে নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন। এমনকি তিনি বাড়ি থেকে বাইরে বের হলেই পথভ্রষ্ট হয়ে হারিয়ে যেতেন বার বার। একবার ওনাকে একরাত একদিন পর তাঁর বাড়ি থেকে অনেক দুরের একটি জায়গায় (বরফ কল মাঠ, নারায়ণগঞ্জ সদর) খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। সেইবার ওনাকে খুঁজে পেতে সবার বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে প্রতিবারই ওনার পূর্বপরিচিত কেউনা কেউ ওনাকে চিন্তে পারতেন এবং বাসায় নিয়ে আসতেন অথবা খবর দিতেন।

\(\qquad\) যাইহোক, ২০১৬ইং সালে ওনাকে আমরা শেষবারের মত ইন্ডিয়া নিয়ে যাই – উদ্দেশ্য ডাক্তার দেখান এবং তীর্থ ভ্রমন। কলকাতায় সবধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হল কিন্তু ডাক্তারা একটা কথাই বলেছিলেন – অনেক দেরী হয়ে গেছে, এখন ওনাদের করার কিছুই নেই, রোগী এখন ডিমেনশিয়ার অন্তিম পর্যায়ে চলে গিয়েছেন। সেইবার আমরা তাঁকে নিয়ে বুদ্ধ গয়া তীর্থ দর্শনে গিয়েছিলাম (তাঁর শেষবারের মত বুদ্ধ গয়া গমন)। বুদ্ধ গয়া থেকে ফিরে আসার ছয় মাসের মাথায় ২০১৭ইং সালের ৪ঠা এপ্রিল, ৭৫বছর বয়সে নিজ বাড়ি (গাবতলী, নারায়ণগঞ্জ)-তে মৃত্যুবরন করেন। যদিও ২০১৪ইং সাল থেকে ওনার সেবা-শুশ্রূষায় নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলাম তাঁর সাথে আমার আর শেষ দেখা হয়নি কারন একই বছর ফেব্রুয়ারীতে আমি উচ্চ শিক্ষার্থে (পি.এইচ.ডি.) থাইল্যান্ড চলে যাই। ওনি সুস্থ থাকতে আমাকে সবসময় ডক্টরেট ডিগ্রী করার জন্য খুব উৎসাহিত করতেন। ওনার সেই ইচ্ছেটা পূরন করতে পেরে নিজেকে আজ ধন্য মনে করছি।

\(\qquad\) পরিশেষে, কঠোর পরিশ্রমী, প্রগতিশীল, নির্ভিক, হিতৈষী ও দানোৎসাহী এই মানুষটির কর্মময় জীবনের স্মৃতির প্রতি আবারও জানাই গভীর শ্রদ্ধা। জগতের সকল প্রানী সুখী হউক


কৃতজ্ঞতা স্বীকার:

\(\qquad\) যাঁরা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে লেখককে সাহায্য করেছেন তাঁরা হচ্ছেন ভদন্ত চন্দ্রবংশ থের:, অধ্যক্ষ, নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় বুদ্ধ বিহার ও ড. শাসনরক্ষিত ধ্যান কেন্দ্র; মিসেস জয়া রানী তালুকদার:, প্রয়াত বাবু বেনুতোষ তালুকদারের স্ত্রী; গায়ত্রী তালুকদার:, প্রয়াত বাবু বেনুতোষ তালুকদারের কন্যা; সুমেধ বড়ুয়া:, অর্থ সম্পাদক, দানোত্তম শুভ কঠিন চীবর দানোৎসব উদযাপন পরিষদ – ২০২২ইং, নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় বুদ্ধ বিহার ও ড. শাসনরক্ষিত ধ্যান কেন্দ্র।

যোগাযোগ: এই প্রবন্ধ সম্পর্কে যে কোন প্রশ্ন ও মন্তব্যের জন্য লেখককে ইমেইল লিখুন এই ঠিকানায় ()।